Success Stories

সিদীপের অনুকরণীয় দুগ্ধ খামারি

নারী  বহ্নিশিখা সালমা খাতুন

                                                                                                                   খামারের মেঝে পরি দিয়ে ধুয়ে পরিষ্কার করছেন সালমা খাতুন

 

একজন নারী বহ্নিশিখার সন্ধান পেয়ে ছুটে গিয়েছিলাম পাবনায়। ১৭ নভেম্বর, ২০২১ বিকেলে যখন তার দেখা পেলাম তিনি তখন দু পায়ে গামবুট পরে হাতে পানির পাইপ ধরে তার গরুর ঘর ধুয়ে সাফসুতরো করছিলেন। টিনের দোচালা গরুর ঘরটির মেঝে পাকা আর চারপাশে বাঁশের চটির বেড়া। অনেকটা বাগানের বেড়ার মতো। আলো-হাওয়ার অবাধ যাতায়াত। খড়কুটোর তলছাদের ফাঁক গলে আসা কয়েক চিলতে রোদ পড়েছে তার মুখে। কপালে বিন্দু বিন্দু জমে থাকা পরিশ্রমের ঘাম রোদের ছোঁয়ায় মুক্তোদানার মতো দ্যুতি ছড়াচ্ছিল। গরুর ঘরের পাশঘেঁষে ছাগল পোষার ছোট্ট এক মাচানঘর। উঠোনের উত্তর-পশ্চিম প্রান্ত থেকে উঁকি দিচ্ছিল বায়োগ্যাস তৈরির অবকাঠামো।  জানতেন আমরা আসবো, তারপরও আমাদের দেখে কিছুটা বিচলিত হলেন যেন! হাতে ধরা পানির পাইপটি মেঝেতে ফেলে দৌড়ে ঘরে ঢুকে গেলেন আমাদের বসার ব্যবস্থা করতে। কিছুকাল আগে এক সড়ক দুর্ঘটনায় পায়ের হাড় ভেঙে যাওয়া তার স্বামী ক্রাচে ভর দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এসে আমাদের অভ্যর্থনা জানালেন। এক লড়াকু দম্পতির সহৃদয় সম্ভাষণে আমরা প্রীত হলাম।

সিদীপের কৃষি প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তাদের যে দলটি এসএমএপি ঋণী সদস্যদের কারিগরি প্রযুক্তির ওপর প্রশিক্ষণ পরামর্শ দিয়ে থাকে তারাই এই কৃতী সফল গরুর খামারি সালমা খাতুনের সন্ধান দিয়েছিলেন। পাবনা জেলার চাটমোহর উপজেলার গুনাইগাছা ইউনিয়নে  পৈলানপুর গ্রামে সালমা খাতুন (৩৮) গরুর যে খামার গড়ে তুলেছেন তার সফলতা গর্ব করে বলার মতো। এই অঞ্চলটি চলন বিলের প্রভাবভুক্ত। আবাদী জমির বেশির ভাগই ছয় মাস থাকে পানির নিচে। বিকল্প জীবিকা খুঁজতে গিয়ে সে কারণেই বোধ করি এলাকার মানুষ গরুর খামার গড়ে তোলায় ঝুঁকে পড়েছিল। দেশের সিংহভাগ দুধ উৎপাদন করে থাকে এই পাবনা সিরাজগঞ্জ জেলার মানুষ। সালমা খাতুন এবং তার স্বামী মো. আজিজুল হকও (৪২) সে পথেই হেঁটেছেন। তবে তাদের এই পথটি বেছে নেয়ার এবং তাতে ঈর্ষণীয় সাফল্য লাভের পেছনে রয়েছে এক অকুতোভয় জীবনসংগ্রামের গৌরবময় কাহিনি। যে কাহিনি অন্যদেরও উদ্বুদ্ধ করে উন্নয়নের অগ্রযাত্রায়। সিদীপ বরাবরই ধরনের উদ্যোক্তাদের নানাভাবে সহায়তা করে থাকে। সালমা খাতুনের বেলায়ও তেমনটিই ঘটেছে।নিজের উন্নয়ন প্রয়াসে তিনি সব সময়ই সিদীপকে পাশে পেয়েছেন। সালমা আজিজুল দুজনেই এজন্য সিদীপের কাছে কৃতজ্ঞ। উদ্যোক্তাদের নানামুখী সেবা প্রদান করে তাদের উগ্যোগ সফল করার জন্য সহায়তা দিয়ে থাকে বলে সিদীপকে তাদের খুব ভালো লাগে। সালমা অকপটেই বললেন, তিনি এবং তার স্বামীতারা মনে করেন আকাক্সক্ষা পূরণে সিদীপকে সব সময় পাশে পাবেনÑ এই ভরসা তাদের রয়েছে।

                                                                                                                                                                                        স্বামী আজিজুল হকের সঙ্গে সালমা খাতুন

 

নিজের সদিচ্ছাগুলো পূরণ করতে গিয়ে প্রবল বাধার মুখে পড়তে হয়েছে সালমা খাতুনকে। বাবার সংসারে এবং সেখান থেকে স্বামীর সংসারে এসেও। তার বাবার বাড়ি এই চাটমোহর উপজেলারই আনকুটিয়া গ্রামে। তার বাবা একজন অবসরপ্রাপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা। চার বোন এক ভাইয়ের মধ্যে তিনি দ্বিতীয়। ভাইটি সবার ছোট। ২০০৪ সালে এসএসসি পাস করেন সালমা। বোনদের ভেতরে লেখাপড়া এবং খুঁটিনাটি নানা বিষয় নিয়ে ছিল খুব রেষারেষি। তাই ২০০৬ সালে একই উপজেলার পৈলানপুর গ্রামের মো. আজিজুল হকের সঙ্গে বিয়ে হওয়ার পর অনেকটাই যেন হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছিলেন। বিয়ের পর আজিজুল তাকে এইচএসসিতে ভর্তি করে দিলে তিনি নতুন করে স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিলেন। কিন্তু সেই স্বপ্ন বিবর্ণ হতে খুব বেশি সময় লাগেনি। স্বামীর সহযোগিতা পেলেও ^শুরবাড়ির পরিবেশ ছিল তার ইচ্ছে পূরণের প্রতিকূল।

 

সালমা-আজিজুলের ঘর

আজিজুলরা ছিলেন চার ভাই, পাঁচ বোন। সবাই স্কুল-কলেজে পড়াশোনা করতেন। ভাইদের ভেতরে তিনি দ্বিতীয়। বড় ভাই আনসারে চাকরি করেন। পড়াশোনার পাশাপাশি আজিজুল বাবার ক্ষেত-খামার দেখাশোনা করতেন, এবং বাড়ির হালের বলদ দুধেল গাভীর যতœ নিতেন। তার ঠিক পরের ছোট ভাই পরে সেনাবাহিনিতে যোগ দিয়েছেন আর সবার ছোট ভাই পরবর্তীতে গ্রামীণ ব্যাংকে চাকরি পেয়েছেন। ননদরা সালমার পড়াশোনায় নানাভাবে বাধা দিত। তারাও পড়াশোনা করত। কিন্তু চাইত না তাদের মতো তাদের ভাবিও লেখাপড়া করুক। তাই ঈর্ষায় তারা তাকে কৌশলে সব সময় রান্নাবান্না এবং নানা সাংসারিক কাজে লাগিয়ে রাখতÑ যাতে সে পড়তে না পারে। স্বামী দূরে ছিল বলে কাউকে কিছু বলতেও পারতেন না সালমা। তার স্বামী তখন গার্মেন্টসে চাকরি করতেন চট্টগ্রামে। এইচএসসিতে রেজাল্ট খারাপ হওয়ায় কয়েক বছর আগে এক আত্মীয়ের মাধ্যমে ঢাকায় এক গার্মেন্টসে কোয়ালিটি ইন্সপেক্টর হিসেবে চাকরি নিয়েছিলেন আজিজুল। বেতন পেতেন মাত্র ১২০০ টাকা। তাতে কোনো রকমে ঢাকায় নিজের খরচ চালাতে পারতেন, বাড়িতে কোনো টাকা-পয়সা পাঠাতে পারতেন না। একজন সহকর্মীর কাছে চট্টগ্রাম ইপিজেড- বিদেশি গার্মেন্টসগুলোর সুযোগ-সুবিধার কথা শুনে তিনি সেখানে যোগাযোগ করলেন এবং একটি কোরিয়ান গার্মেন্টস- চাকরি পেয়েও গেলেন। বেতন-ভাতা বেশি পেলেও এখানে পদমর্যাদা নিচে নেমে গেল। হেলপার হিসেবে চাকরি করার শর্ত মেনে নিতে হয়েছিল তাকে। দু বছর পরে অবশ্য তিনি প্যাকিং সেকশনে সুপারভাইজর হয়েছিলেন। সেখানে শুক্রবারে কোনো ওভারটাইম করানো হতো না, সুযোগ-সুবিধা ছিল সরকারি চাকরির মতোই। দুপুরে মালিকের পক্ষ থেকে খাবারও দেয়া হতো। অনেকে খাবার না দিয়ে খাবারের জন্য টাকা দিতে বললে মালিক বলতেনÑ ‘এদের হাতে টাকা দেয়া যাবে না। বাঙালি হাতে টাকা পেলে দুপুরে বানরুটি-চা খেয়ে কাটিয়ে দেবে। শরীরের স্ট্রেংথ কমে যাবে। আমি চাই কাজ, তাই পেট ভরে খাইয়ে তাদের শরীরের তাকত ঠিক রাখতে হবে।

২০০৬ সালে বিয়ে করেছিলেন আজিজুল। তখন তিনি চট্টগ্রামে গার্মেন্টসে চাকরি করতেন। স্ত্রীকে কলেজে ভর্তি করিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু ^শুরবাড়ির বৈরী পরিবেশ বছর না ঘুরতেইসালমার পড়াশোনার সব আগ্রহ শুষে নিয়েছিল। তিনি স্বামীর সঙ্গে চট্টগ্রামে যাওয়ার বায়না ধরলেন। আজিজুলকে অগত্যা রাজি হতে হয়েছিল। ছোট একটি বাসা ভাড়া করে তিনি সালমাকে নিয়ে গিয়েছিলেন। আজিজুল কাজে চলে গেলে একা একা সালমার সময় কাটতে চাইত না। ছোট শিশুদের পড়াতে শুরু করেছিলেন তিনি। এভাবে দু মাস কাটার পর সালমাও একটি গার্মেন্টসে চাকরি নিয়েছিলেন। বেতন পেতেন মাসে ২৮০০ টাকা করে। বেশ ভালোই চলছিল তাদের সংসার। আজিজুল জানালেন, বাড়িতে টাকা পাঠাতে না হলে তিনি এমনকি সহকর্মীদের সঙ্গে মিলে চট্টগ্রামে জমি কেনারও সক্ষমতা অর্জন করেছিলেন তখন। কিন্তু একদিন মালিক তাদের যখন গর্বের সঙ্গে তাদের জানিয়েছিল বছরে তার ৭০০ কোটি টাকা লাভ হয়েছে, তখন আজিজুলের মনের মধ্যে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর এক অদম্য স্পৃহা জেগে উঠেছিল। তিনি নিজেকে প্রশ্ন করেছিলেনÑআমাদের পরিশ্রমের আয়ে যদি মালিক বছরে ৭০০ কোটি টাকা লাভ করে থাকে তা হলে আমার নিজের পরিশ্রম দিয়ে আমি আমার নিজের ভবিষ্যত গড়ছি না কেন? বিষয়টি নিয়ে স্ত্রীর সঙ্গে আলাপ করলেন। নিজেদের শ্রমে নিজেদের ভবিষ্যত গড়তে পারলেই সবচেয়ে ভালো হয়Ñ এই উপলব্ধি থেকে তারা অটল সিদ্ধান্তে পৌঁছলেন যে, গার্মেন্টসের চাকরি ছেড়ে দিয়ে তারা বাড়িতে এসে নিজেরাই কিছু একটা করবেন। তারা করলেনও তাই।

 

২০১০ সালের ডিসেম্বরে তারা চাকরি ছেড়ে বাড়িতে চলে আসেন। বাড়িতে এসে স্ত্রীকে নিয়ে আজিজুল বাবার বাড়িতেই উঠেছিলেন।চাকরিতে ঢোকার আগে আজিজুল বাবার সংসারের গবাদিপশুর দেখাশোনা করতেন বলে চট্টগ্রাম থেকে ফিরে এসে গাভী পালনের সিদ্ধান্ত নেন, যা সালমা খাতুনেরও খুব মনে ধরে গিয়েছিল। এলাকার অনেকেই গাভী পালন করে লাভবান হচ্ছিলÑ সেই উদাহরণও আজিজুল সালমাকে অনুপ্রাণিত করেছিল। চাকরি ছেড়ে দেয়ার পর আজিজুল লাখ টাকা পেয়েছিলেন।সেই টাকা থেকে বাবার হাতে ৫০ হাজার টাকা তুলে দিয়ে বাকি টাকা থেকে ৪৪ হাজার টাকা দিয়ে একটি দো-আঁশলা জাতের গাভী কিনেছিলেন। সালমা গাভীটিকে গভীর মমতায় লালন-পালন করতেন। আজিজুল বাবার কাছ থেকে ১০ কাঠা জমি চেয়ে নিয়েছিলেন গরুর জন্য নেপিয়ার ঘাস চাষ করবেন বলে। সেই গাভীটি দিনে লিটার করে দুধ দিত। প্রথম দিকে আজিজুল আলেফ নামের একজন বড় খামারির কাছে এই দুধ বিক্রি করতেন প্রতিলিটার ২৬ টাকা দরে। প্রাণ কোম্পানি তখন দুধ কিনত (এখনও একই দামে কেনে) লিটারপ্রতি ৪২ থেকে ৪৫ টাকা দরে। দুধে ননির পরিমাণের ওপর দাম নির্ভর করে। সাধারণত সকালের দিকে দেয়ানো দুধে ননি কম থাকে এবং বিকেলের দুধে ননি বেশি থাকে।কিন্তু দুধের পরিমাণ অল্প বলে আজিজুল সেখানে যেতে সাহস পেতেন না। অবশেষে সাহস করে তিনি একদিন গুনাইগাছায় প্রাণ কোম্পানির অফিসে গিয়ে বললেন, ‘আমার গাভী অল্প পরিমাণ দুধ দেয়, আপনারা কি এতো অল্প দুধ নেবেন?’ জবাবে তারা জানিয়েছিলÑ আধা লিটার দুধ হলেও তারা নেবে। সেই থেকে তিনি প্রাণ কোম্পানিতে দুধ বিক্রি করেন। এখন তিনি কোম্পানিটিতে একজন নিবন্ধিত দুধ বিক্রেতা। এখনো তিনি সেখানে দুধ বিক্রি করেন। প্রাণ কোম্পানি থেকে বছরে এক ঈদে তাদের বোনাসও দেয়া হয়। আগে বছরে তারা যতো লিটার দুধ সরবরাহ করতেন ততো টাকা বোনাস দেয়া হতো, এখন দেয়া হয় লিটারে টাকা করে। দেশের সবচেয়ে বেশি দুধ উৎপন্ন হয় বলে পাবনা সিরাজগঞ্জে ব্র্যাক, প্রাণ, মিল্কভিটা ইত্যাদি দুগ্ধ প্রক্রিয়াজাতকরণ কোম্পানিগুলো দুধের গুণগত মান বাড়াতে এই এলাকায় গরুর খামারিদের ভেতর ন্যায্যমূল্যে উন্নতমানের ঘাসের বীজ এবং দানাদার গো-খাদ্য সরবরাহ করে থাকে। আজিজুল একবার ব্র্যাক থেকে জাম্বু ঘাসের বীজ সংগ্রহ করে চাষ করেছিলেন এবং প্রাণ কোম্পানি থেকে দানাদার গো-খাদ্য সংগ্রহ করে থাকেন।

বছরখানেক পরে প্রথম গাভীর এঁড়ে বাছুরটি বড় হলে তিনি ৫০ হাজার ৫০০ টাকায় বিক্রি করেছিলেন। এতে তারা স্বামী-স্ত্রী দুজনেই গাভী পালনে খুব উৎসাহিত হয়ে পড়েন। কিন্তু সেভাবে জাত বিচার না করে ৫৫ হাজার টাকা দিয়ে দ্বিতীয় গাভীটি কিনে লোকসানে পড়েন। ২০ হাজার টাকা লোকসান গুনে সেই গাভীটি তাদের বিক্রি করতে হয়েছিল ৩৫ হাজার টাকায়। এর মধ্যে প্রথম গাভীটি আবার প্রসব করলে তারা আবার মনপ্রাণ ঢেলে সেটির যতœ নিতে থাকেন। এর ভেতরে ঘটে যায় এক পারিবারিক দুর্ঘটনা। প্রথম এঁড়ে বাছুরটি বিক্রি করার পর আজিজুলের বড় ভাবি আনসারে চাকরি করা তার স্বামীর কাছে চিঠি লিখে জানান যে, ‘... তোমরা চাকরি করে আর কয় টাকা পাও? তোমার ভাই তার বাবার কাছ থেকে জমি নিয়ে ঘাস চাষ করে গরু পুষে বিক্রি করে তো অনেক বড়লোক হয়ে গেল!’ বড় ভাইয়ের কাছ থেকে কথা শুনে আজিজুলের সেনাবাহিনিতে চাকরি করা ভাই বাড়ি এসে আজিজুলকে আক্রমণ করে। আজিজুলের হাতে ছিল তখন দা, যা নিয়ে তিনি রুখে দাঁড়ান। ব্যাপারটা খুনোখুনির পর্যায়ে চলে যাচ্ছে দেখে তার বড় ভাবি এবং অন্যরা ছুটে এসে তাদের থামান। তার বড় ভাবি তখন বলেনÑ ‘তোরা থাম ভাই, আমি আর কোনোদিন এমন চিঠি লিখব না।দুজনকেই হাসপাতালে যেতে হয়েছিল। এই ঘটনার পর বাকি তিন ভাই একজোট হয়ে বাবাকে আজিজুলকে গৃথক করে দিতে বলেন। তাদের বাবার ছিল ১০ বিঘা জমি। বাবা অনেকটা বাধ্য হয়ে আজিজুলকে পৃথক করে দেন।

আলাদা সংসার এবং খামারের গোড়াপত্তনআজিজুল তখন আলাদা বাড়ি করতে চাইলে তার বাবা তাকে পৈলানপুরে শতকের একটু বেশি জমির এই ভিটেটি দিয়ে দেন। / কেজি চাল দুটি রান্নার হাঁড়ি দিয়ে তাদের পৃথক করে দেয়া হয়। তাদের প্রথম সন্তান মো. তৌহিদুল ইসলামকে নিয়ে তারা নতুন বাড়িতে এসে ওঠেন ২০১৫ সালের ঘটনা এটি। আজিজুল তখন এই ২২ হাত বাই হাত ইটের দেয়ালের টিনের ঘরটি তুলে এখানে চলে আসেন। গরুর জন্য ১২ হাত বাই হাত একটি টিনের দোচালা তুলে নেন। ভীষণ কষ্ট করে চলতে হয়েছে তখন তাদের। এমনকি নিয়মিত দুধ সরবরাহ করতে না পারায় প্রাণ কোম্পানি সময় দুধ বিক্রেতা হিসেবে তাদের নিবন্ধনও বাতিল করেছিল। প্রাণ কোম্পানি দুধের দাম ব্যাংকের মাধ্যমে পরিশোধ করতো বলে আজিজুলকে ওয়ান ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট খুলতে হয়েছিল। কিন্তু সময়ে অ্যাকাউন্টে কোনো টাকা জমা ছিল না।  সালমা জানালেন সে সময় তিন মাসেরও বেশি সময় তারা গুঁড়োমাছও কিনে খেতে পারেননি। কথা বলার সময় সালমার চোখ দুটি ভিজে উঠেছিল।এরপর আজিজুল মনে মনে ভাবতে থাকেন এই গাভীর খামারে কী করে সারা বছর দুধ উৎপাদন করা যায়Ñ যাতে প্রাণ কোম্পানির নিবন্ধন হালনাগাদ রাখা যায় এবং খামারটিকে কী করে আরো লাভজনক করে তোলা যায়।এলাকার ভালো খামারগুলো খুঁটিয়ে দেখতে থাকেন এবং তাদের গরু পালনের কৌশল, পুঁজি সংগ্রহ অন্যান্য বিষয় খেয়াল করতে থাকেন। এসব নিয়ে ভাবতে ভাবতে এক সময় ঠিক করে ফেলেন এনজিও থেকে ঋণ নেবেন। বিভিন্ন এনজিও সম্পর্কে খোঁজখবর নিয়ে জানতে পারেন সিদীপ নামের একটি এনজিও থেকে শুধু ঋণই দেয়া হয় না, কৃষি প্রাণিসম্পদ বিষয়ে প্রশিক্ষণ পরামর্শ দেয়া হয়, এর সদস্যদের স্বাস্থ্যসেবা দেয়া হয় এবং শিশুদের লেখাপড়ায়ও তারা সহায়তা করে থাকে। তাই তিনি এই সিদীপ থেকে ঋণ নিয়েই খামারে পুঁজির ঘাটতি মেটাবেন বলে ঠিক করলেন। মনে মনে তার পরিকল্পনাটা ছিল রকমেরÑ দুধ বিক্রি করে তিনি কিস্তির টাকা পরিশোধ করবেন, গাভীটা থেকে যাবে মূলধন হিসেবে আর বাছুরটা হবে বোনাস।

তাদের বাড়ির পাশেই ছিল সিদীপের পৈলানপুর মহিলা সমিতির সভানেত্রী আসমানি বেগমের বাড়ি। আজিজুল সালমাকে তার কাছে পাঠান সিদীপের সমিতিতে ভর্তি হতে। আসমানি এবং সমিতির অন্য সদস্যরা তাকে সদস্য করতে সোৎসাহে রাজি হয়ে যান। ২০১৫ সালের ১৯ আগস্ট সালমা খাতুন এই সমিতির সদস্য পদ লাভ করেন। সমিতির সদস্য হওয়ার পর সভানেত্রীর পরিচালনায় অনুষ্ঠিত সাপ্তাহিক সভায় অংশ নেন। সিদীপের দায়িত্বপ্রাপ্ত ফিল্ড অফিসার সভায় তাদের ঋণ কার্যক্রম নিয়ে আলোচনা করেন এবং সিদীপের উপ-সহকারী কমিউনিটে মেডিক্যাল অফিসার নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা শেষে সমিতি সদস্য এবং তাদের পরিবারের অসুস্থ সদস্যদের প্রাথমিক স্বস্থসেবা দেন। এই সভাতে  তিনি ঋণ নেয়ার ইচ্ছের কথা জানালে সমিতির সভানেত্রী আসমানি বেগম সিদীপের বালুচর শাখার ব্রাঞ্চ ম্যানেজারের কাছে সালমার ঋণ প্রস্তাব সুপারিশ করেন এবং সাপ্তাহিক সঞ্চয় জমা করতে থাকেন। সিদীপের শাখা অফিস থেকেতার ব্যাপারে খোঁজখবর নিয়ে ঋণ প্রস্তাব যাচাই-বাছাই শেষে সে মাসেরই ২৭ তারিখ তাকে ৪০,০০০ হাজার টাকা ঋণ দেয়া হয়। সেই ঋণের টাকার সঙ্গে আগের একটি গরু বিক্রির টাকা এবং কিছু জমানো টাকা মিলিয়ে লাখ হাজার টাকা খরচায় তারা একটি শাহিওয়াল গাভী কেনেন। শাহিওয়াল হচ্ছে জেবু জাতের গরু, যেগুলোকে প্রধানত দুধ উৎপাদনের জন্য পালন করা হয়। জেবু জাতের গরুর মধ্যে শাহিওয়াল গরুই সবচেয়ে বেশি দুধ দেয়। এই গাভীটি থেকে সালমা দিনে ১৬ থেকে ১৮ লিটার দুধ পেতেন। এই সময় তার তিনটি গাভী ছিল। প্রথম গাভীটি ছাড়াও একটি বকনা বাছুর ততোদিনে গাভী হয়ে গিয়েছিল। তবে তিনটি গাভী থেকে এক সঙ্গে দুধ পেতেন না। একটি দুধ দেয়া বন্ধ করলে আরেকটি হয়তো দুধ দিতে শুরু করত। এভাবে প্রাণ কোম্পানিতেতখন সারা বছরই দুধ সরবরাহ করতে পারতেন।এর পরের বছর, মানে ২০১৬ সালে সিদীপ থেকে দুই দফায় ঋণ নিয়েছিলেন। প্রথম দফায় নিয়েছিলেন ২০ হাজার টাকা এবং দ্বিতীয় দফায় ৬০ হাজার টাকা। বছর সালমা লাখ ৩৫ হাজার টাকায় একটি হোলস্টাইন ফ্রিজিয়ান জাতের গাভী কিনেছিলেন। বিশে^ সবচেয়ে বেশি দুধ দেয় ছোপ ছোপ সাদা-কালো জাতের এই গাভী।  সময় তিনি গড়ে দিনে ৩২ লিটার করে দুধ পেতেন। ঘাস, দানাদার খাবার ইত্যাদি মিলে দিনে তার খরচ হতো ৯৩০ টাকা এবং দুধ বিক্রি করতেন রোজ ১৩৫০ টাকার, অর্থাৎ রোজ তার লাভ থাকত ৪২০ টাকা।

সালমা তার বকনা বাছুরগুলো রেখে দিতেন এবং এঁড়ে বাছুরগুলো একটু বড় করে বিক্রি করে দিতেন। এর ভেতর তিনি একটি এঁড়ে বাছুর ৯৫ হাজার ৫০০ টাকায় এবং অন্য আরেকটি এঁড়ে বাছুর বিক্রি করেছিলেন ৯১ হাজার টাকায়। আরো কয়েকটি এঁড়ে বাছুর বিক্রি করেছেন তিনি এবং সবটিই ৫০ হাজার টাকার ওপরে। ২০১৮ সালে দু দফায় ঋণ নিয়েছেন ৪০ হাজার এবং ১৫ হাজার টাকা। ২০১৯ সালে দু দফায় নিয়েছেন ৭০ হাজার এবং ২০ হাজার টাকা। ২০২০ সালে ঋণ নিয়েছিলেন ৩০ হাজার টাকা এবং ২০২১ সালে কোভিড-১৯- ক্ষতিগ্রস্ত হিসেবে সিদীপ থেকে তিনি আরআরএসএল ঋণ নিয়েছেন লাখ টাকা। সিদীপ থেকে নেয়া ঋণের সব টাকাই তিনি বিনিয়োগ করেছেন গাভী পালনে। ২০২০ সালে একটি রিক্সাভ্যান কিনেছেন ১৫ হাজার টাকায়Ñ সেটিও প্রাণ কোম্পানিতে গরুর দুধ সরবরাহ এবং গরুর ঘাস বহনে ব্যবহার করেন। তার মানে এটিও গাভী পালন সংক্রান্ত ব্যয়। সর্বশেষ অস্ট্রেলিয়ান জাতের একটি গাভী কিনেছেন তিনি লাখ ১১ হাজার টাকায়।

গাভী দোয়চ্ছেন সালমা খাতুন

দুধ সংগ্রহ : সালমা খাতুন তার খামারের গরুর দুধ সংগ্রহের জন্য এখনো কোনো যান্ত্রিক ব্যবস্থা গ্রহণ করেননি। আমি তাকে দুধ দোয়ানোর মেশিনের কথা বললে তিনি জানালেন, তাদের অবস্থা এখনো সে পর্যায়ে পৌঁছেনি। এখানকার এক বড় খামারি নাকি দুধ দোয়ানোর মেশিন কিনে এনেছিলেন, কিন্তু সে মেশিনে দুধ দোয়াতে পারেননি, কারণ গাভীর ওলানে সে মেশিন লাগানোমাত্র গরু লাফালাফি শুরু করে দেয়। আমি তাকে আর বলতে গেলাম না যে, বাংলাদেশেরই অনেক খামারি এখন মেশিনে দুধ সংগ্রহ করছেন। ব্যাপারটা অভ্যাস এবং দৃষ্টিভঙ্গির। তারা যখন দেখবেন মেশিনে দুধ সংগ্রহ সহজ এবং সময়ও বাঁচে তখন এই সালমারাই এক সময় মেশিনে দুধ সংগ্রহ শুরু করবেন। সে যাই হোক, সালমা খাতুনের দুধ সংগ্রহের তথ্য জানতে গিয়ে এক মজার ঘটনা জানতে পারলাম। আর তা হচ্ছেÑ প্রথম গাভীটির দুধ দোয়াতেন আজিজুল নিজে। কিন্তু দ্বিতীয় গাভী থেকে শুরু করে পরের কোনো গাভীই আজিজুলকে দুধ দোয়াতে বসতে দেয়নিÑ লাথি মেরে সরিয়ে দিয়েছে। অবাক করা ব্যাপার হচ্ছে, সালমা দুধ দোয়াতে বসলেই সেসব গাভী চুপচাপ থাকে, একটুও নড়াচড়া করে না। তাই বাধ্য হয়ে তার পর থেকে সালমাকেই দুধ দোয়াতে হয়। তারা দিনে চারবার দুধ সংগ্রহ করেন এবং এখন সালমাকে ১০টি গাভী দোয়াতে হয়। তার মানে দিনে তাকে ৪০ বার দুধ দোয়াতে হয়। খুব ভোরবেলা একবার এবং সকাল ৯টার দিকে দুধ সংগ্রহ করার পর আজিজুল ভ্যানে করে প্রাণ কোম্পানিতে দিয়ে আসেন। আবার দুপুর সন্ধ্যায় আরেক দফা দুধ সংগ্রহ করে প্রাণ কোম্পানির দুধ সংগ্রহ কেন্দ্রে দিয়ে আসেন।

এই ভ্যানে করে সালমা খাতুনের স্বামী আজিজুল হক দুধ ঘাস পরিবহন করেন

 

বর্তমান অবস্থা : বর্তমানে তার খামারে মোট ২১টি গরু। এর ভেতরে ১০টি গাভী দুধ দিচ্ছে, বকনা বাছুর আছে ৫টি এবং ৬টি আছে এঁড়ে বাছুর। তিনি এখন দিনে ৮০ থেকে ৯০ লিটার দুধ পান। গাভীর খামার চালাতে গিয়ে এখন তিনি কোনো সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছেন কিনাÑ এমন প্রশ্নের জবাবে সালমা বলেন, বিভিন্ন রকমের সমস্যা মোকাবেলা করে এগিয়ে যেতে হচ্ছে তাকে। 

নিজেদের বাড়িতে ওঠার পর থেকে তারা দুজনেই ফজরের ওয়াক্ত থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত যেমন কঠোর পরিশ্রম করেছেন, তেমনি খুব হিসেব করে চলেছেন। গরুর সংখ্যা বাড়লেও কোনো কাজের লোক রাখেননি। কিন্তু গত বছর তার স্বামী ঘাসের আঁটি রাখতে গিয়ে গরুর ঘরের পাকা উঠোনে পড়ে গেলে কনুই ভেঙে ছয় মাস বিছানায় পড়ে ছিলেন। সালমা খাতুনকে তখন বাধ্য হয়ে গরুর ঘাস কাটার জন্য একজন লোক রাখতে হয়েছে। দিনে তাকে ৩০০ টাকা দিতে হয়, বিনিময়ে সে দু বেলা ঘাস কেটে দিয়ে যায়। এরপর বছর এপ্রিল মাসে পাবনার কাছাকাছি এক সড়ক দুর্ঘটনায় তার স্বামীর পা ভেঙে গেলে প্রথমে লোকজন তাকে পাবনা হাসপাতালে নিয়ে যায়। একটি জটিল অপারেশন করতে হবে বলে সেখান থেকে তাকে রাজশাহীর ঝাউতলায় আমেনা হাসপাতালের ডা. দেবাশিসের কাছে রেফার করা হয়। সফল অপারেশ শেষে তিনি তার স্বামীকে বাড়িতে পাঠিয়ে দেন। তবে একুশ দিন ইনজেকশন দেয়ার ব্যবস্থাপত্র দেন। সালমা তখন সিদীপের বালুচর শাখার উপ-সহকারী কমিউনিটি মেডিক্যাল অফিসারকে ফোন করে তার সমস্যার কথা জানান। বাইরের ডাক্তারখানার লোক ডেকে এনে ইনজেকশন দিতে গেলে রোজ তাকে দুই/আড়াই টাকা গুনতে হতো। সিদীপের স্বাস্থ্যসেবা কর্মসূচির এই কর্মকর্তা পরদিন থেকে ঈদের ছুটিতে বাড়ি যাওয়ার তোড়জোড় করছিলেন, কিন্তু সালমার ফোন পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে তিনি ছুটে আসেন এবং আজিজুলের হাতে ক্যানোলা লাগিয়ে দেন, যাতে সালমা নিজেই বাকি ইনজেকশনগুলো দিতে পারেন। স্বামীর অসুস্থতা ছাড়া আরো যেসব সমস্যায় পড়তে হচ্ছে সালমাকে তার ভেতর অন্যতম হচ্ছেÑ তিনি এখনো তার খামার ঘিরে বেড়া দিতে পারেননি বলে বাছুরগুলো ছেড়ে পুষতে পারেন না। ছাড়া পেলেই এগুলো অন্যের ক্ষেতে ঢুকে পড়ে বা প্রতিবেশীদের গাছে মুখ দেয়, আর তখন তাকে অনেক গঞ্জনা সইতে হয়। ছাড়া তার সাফল্যে অনেক প্রতিবেশী ঈর্ষান্বিত হয়ে নানা বিরূপ আচরণ করে থাকে। এতোসব প্রতিকূলতা সামলে সালমা একাই তার খামারকে লাভজনকভাবে পরিচালনা করছেন।

কৃষিজমির ব্যবহার : গরুর সংখ্যা বেড়ে যেতে থাকলে ঘাস চাষের জন্য সালমার আরো জায়গার দরকার হয়ে পড়ে। তিনি তখন তার স্বামীকে বলে ২৫ হাজার টাকা দিয়ে আড়াই বিঘা জমি লিজ নেন। সেই জমিতে তিনি নেপিয়ার জাম্বু ঘাস চাষ করতে থাকেন। পরে আরো এক বিঘা জমি লিজ নিয়েছেন, তবে জমিটুকু বছরে ছয় মাস পানির নিচে থাকে। এই জমিতেও ঘাস চাষ করেন তারা।শ^শুরবাড়ি থেকে এই বসতভিটেটুকু ছাড়াও বছরখানেক আগে দেড় বিঘা জমি পেয়েছেন। সে জমিতেও মূলত ঘাস চাষ করেন। আজিজুল জমিতে একবারই ধানের আবাদ করেছিলেন এবং সেবার ২৮ মণ ধান পেয়েছিলেন। আসলে তাদের সমস্ত কর্মকা- এই গরুর খামারকে ঘিরে, তাই জমিতে ঘাস ছাড়া অন্যকিছু আবাদ করলেও সেই আবাদের শস্য ঘরে না তুলে কাঁচা অবস্থায় ক্ষেত থেকে কেটে এনে তা গরুকে খাওয়ান। গম খেসারি চাষ করেন মাঝে মাঝে, তবে সেই কচি গমগাছ খেসারিগাছ গরুকে খাওয়ান।

     সালমার বায়োগ্যাস প্ল্যান্ট

 

বায়োগ্যাস প্লান্ট : সালমা খাতুন তার খামারের গোবরকে কাজে লাগিয়েছেন খুবই বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে। নিজেদের জমিতে সার হিসেবে ব্যবহারের পাশাপাশি বায়োগ্যাস উৎপাদন করছেন বছর দুয়েক আগে থেকে। ২০১৮ সালেসবুজ বাংলানামে একটি বায়োগ্যাস অবকাঠামো নির্মাণকারী সংস্থাকে দিয়ে বায়োগ্যাস উৎপাদনের ব্যবস্থা করেছেন ৩৫ হাজার টাকা খরচায়। তিনি এই টাকা কিস্তিতে পরিশোধ করেছেন। বাড়িতে বায়োগ্যাস থাকায় এখন আর তাকে লাকড়ির চুলা ¦ালাতে হয় না। সালমা জানালেন, বায়োগ্যাস করায় তার খামারের জন্য খুব সুবিধা হয়েছে।

হাঁস-মুরগি-ছাগল : সালমা খাতুন বর্তমানে তার বাড়িতে ৪টি হাঁস, ৬টি মুরগি ৬টি ছাগল পুষছেন। ছাগল ৬টির মধ্যে ২টি বড় এবং ৪টি রয়েছে ছাগলছানা। সিদীপের কৃষি প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তার পরামর্শে ছাগলের ছোট্ট টিনের চালায় মাচা করে নিয়েছেন। এতে ছাগলের রোগবালাই কম হচ্ছে।

 

সালমা খাতুনের ছাগলের ঘর

খামারের ব্যবস্থাপনা : সালমা আজিজুল অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে তাদের গরুর খামার পরিচালনা করছেন। খামার শুরু করার পরপরই প্রাণ কোম্পানি থেকে কম খরচে কীভাবে গরুর খামারকে লাভজনক করে তোলা যায় তার ওপর প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। তারা সেই প্রশিক্ষণ কাজে লাগিয়ে তাদের খামারটিকে বড় করে তুলছেন। তাদের ভেতরে সালমার রয়েছে দক্ষ পরিচালনার সহজাত গুণ। তার বাবা অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা শক্ত দক্ষ হাতে সংসার চালান, তার সেই গুণ সালমাও পেয়েছেন। প্রায় দেড় বছর ধরে অসুস্থতার কারণে তার স্বামী গরুর খামারের কোনো কাজ করতে পারেন না। সালমা সময়ে একা একা খামারের সব কাজ শুধু করছেনই না, আগের যে কোনো সময়ের তুলনায় এটিকে তিনি আরো লাভজনকও করে তুলেছেন।

   সালমা খাতুন আজিজুল হকের বাড়ি

 

রোগবালাই দমন : খামারের রোগবালাই দমনে সালমা সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করে থাকেন। তিনি বেশ ভালো করেই জানেন একবার রোগবালাই হানা দিলে তার খামারের ভীষণ ক্ষতি হয়ে যাবে। ব্যাপারে তিনি বড় বড় খামারিদের অনুসরণ করেন এবং নিজেও সময়মতো যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। প্রাণ কোম্পানির নিবন্ধিত দুগ্ধ খামারি বলে তাদের ভ্যাটেরিনারি ডাক্তার নিয়মিত তার খামার পরিদর্শন করেন এবং প্রয়োজনীয় চিকিৎসা ওষুধ দিয়ে যান। তা ছাড়া তিনি নিজেও উপজেলা প্রাণিসম্পদ অফিসে গিয়ে পরামর্শ নিয়ে আসেন। সিদীপের প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তাও নিয়মিত তার খামার পরিদর্শন করে তাকে নানা পরামর্শ দেন।

গরুর ঘর : সালমা খাতুনের এখন দুটি গরুর ঘর। দুটিই টিনের দোচালা। একটির মেঝে পাকা, আরেকটির কাঁচা। প্রথম যখন বাড়িতে এসে ওঠেন তখন তার গরুটি একটি খড়ের ঝুপরিতে রাখতেন। শাহিওয়াল গাভীটি কেনার পর ১২ হাত বাই হাত একটি টিনের দোচালা তুলে নিয়েছিলেন। গরুর সংখ্যা বাড়তে থাকায় ২০১৮ সালে লাখ ৬৫ হাজার টাকা খরচ করে ২৬ হাত বাই ১৫ হাত মাপের এই টিনের দোচালা ঘরটি তুলেছেন তারা।  ঘরটির মেঝে পাকা এবং খাবার দেয়ার জায়গা পানি রাখার জায়গা পাকা গাঁথুনি দিয়ে বাঁধানো।

সালমা খাতুনের বর্তমান সম্পদের পরিমাণ : কয়েক বছর আগে সালমার বাবার চিকিৎসার জন্য হঠাৎ খুব টাকার দরকার হলে তিনি কাঠা জমি বিক্রি করবেন বলে ঠিক করেছিলেন। জানতে পেরে সালমা তার বাবাকে রাজি করিয়ে নিজেই সে জমি কিনে রেখেছিলেন লাখ টাকায়। নিজের গয়নাগাটিচট্টগ্রামে গার্মেন্টসে চাকরি করার জমানো টাকা এবং তাদের সংসারের জমানো টাকা দিয়ে তিনি সেই জমি কিনেছিলেন কয়েক বছর আগে। সেই জমিতে তিনি মেহগনি গাছ লাগিয়ে রেখেছেন। এখন এর আনুমানিক মূল্য হবে ,০০,০০০ টাকা। শতক বসতভিটে ছাড়াও বাবার দেয়া জমি আছে পৌনে দুই বিঘা। লিজ নেয়া জমি আছে সাড়ে তিন বিঘা। তার বাড়িতে ফ্রিজ আছে, তবে টেলিভিশন নেই। দুইটি খাট রয়েছে। তার আসবাবপত্রের মোট আনুমানিক মূল্য ৯০,০০০ টাকা। গরুর ঘরের আনুমানিক মূল্য ,০০,০০০ টাকা, ছোট গরুর ঘরের আনুমানিক মূল্য ১৫,০০০ টাকা, ৪টি ছাগলের আনুমানিক মূল্য ১৫,০০০ টাকা। হাঁস-মুরগির আনুমানিক মূল্য ২০০০ টাকা, বায়োগ্যাস প্ল্যান্টে খরচ ৩৫,০০০ টাকা। একটি পানির মোটর কিনেছেন ,০০০ টাকায়। জমির মোট আনুমানিক মূল্য ২৫,০০,০০০ টাকা। অর্থাৎ তার সম্পদের আনুমানিক মোট মূল্য ২৯ লাখ ৬৩ হাজার টাকা।

সালমা খাতুনের পরিবার : স্বামী-সন্তান নিয়ে সালমা খাতুনের পারিবারিক সদস্য জন। স্বামী আজিজুল হকের বয়স ৪২ বছর, তার নিজের বয়স ৩৮ বছর। তাদের এক ছেলে এবং এক মেয়ে। ছেলে মো. তৌহিদুল ইসলাম তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ে, মেয়ে মোসাম্মৎ তাসলিমা খাতুন এখনো ছোটÑ স্কুলে যাওয়ার বয়স হয়নি।

 

সালমা এলাকায় এখন এক অনুকরণীয় উদাহরণ : গাভী পালনে সালমা খাতুনের সাফল্য অনেককেই অনুপ্রাণিত করছে। তারা উদ্বুদ্ধ হচ্ছেন তার মতো গাভীর খামার গড়ে তুলতে। নুরুজ্জামান নামে তার এক প্রতিবেশী গাভীর খামার করার জন্য তার কাছ থেকে পরামর্শ নিচ্ছেন। আনসারে চাকরি করা সালমা খাতুনের বড় ভাসুরও তার কাছ থেকে পরামর্শ নিয়ে গাভীর খামার গড়তে চাইছেন। সালমার ছোট দুই বোনও তাকে অনুসরণ করে গরুর খামার গড়তে চাইছেন।

সিদীপের প্রতি তার ধারণা কৃতজ্ঞতা : সালমা মনে করেন সিদীপ খুব ভালো একটি উন্নয়ন সংস্থা। তারা তাদের গ্রাহকদের শুধু ঋণই দেয় না, তাদের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নেও নানাভাবে সহায়তা করে। বিশেষ করে সিদীপের শিশুশিক্ষা স্বাস্থ্য সেবা এলাকার মানুষের অনেক উপকার করছে বলে মনে করেন তিনি। সালমা খাতুন আজিজুল হক গরুর খামারে তাদের এই সাফল্যের জন্য সিদীপের প্রতি অকুণ্ঠ কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলেন। সালমা জানালেন, তিনি যে একটার পর একটা উন্নত জাতের গাভী কিনে তার খামারকে বড় করে তুলতে পেরেছেন, এর পেছনে এক অনন্য ভূমিকা রেখেছে সিদীপের ঋণ সহায়তা। শুধু ঋণ সহায়তাই নয়Ñ তার গাভী পালন, খামারের রোগ প্রতিরোধ, গরু মোটাতাজাকরণ, মাচা পদ্ধতিতে ছাগল পালন ইত্যাদি নানা বিষয়ে সিদীপের কৃষি প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা সব সময় তাকে গঠনমূলক পরামর্শ দিয়েছেন। সিদীপের বালুচর শাখা অফিসে আয়োজিত প্রশিক্ষণ কর্মশালায় অংশ নিয়ে তিনি অনেক উপকৃত হয়েছেন। তার স্বামীর চিকিৎসায় সিদীপ যেভাবে তার পাশে দাঁড়িয়েছে তার জন্য তিনি গভীর কৃতজ্ঞতা জানালেন সিদীপের প্রতি। আশা প্রকাশ করে তিনি বললেন, সিদীপের সার্বিক সহায়তায় তিনি তার আকাক্সক্ষা পূরণ করতে পারবেন।

ভবিষ্যত পরিকল্পনা : সালমা ভবিষ্যতে তার খামারটিকে আরো অনেক বড় করে তুলতে চান। যদিও আজিজুল এখন চাইছেন, গরু বিক্রি করে এনজিওসহ সবার দেনা শোধ করে যে কয়টা গরু থাকে তাতেই সুখে সময় কাটাবেন, কিন্তু সালমা তার সঙ্গে সম্পূর্ণ ভিন্ন মত পোষণ করেন। তিনি তার খামারকে দেশের শীর্ষস্থানীয় একটি খামারে পরিণত করতে চান। দৃঢ় কণ্ঠে সালমা খাতুন জানালেন, বিয়ের আগে বাবার সংসারে কোণঠাসা হয়ে থাকতে হয়েছে, বিয়ের পর ^শুরবাড়িতে গঞ্জনা সইতে হয়েছে; এখন এই গরুর খামার করে তার যে অভিজ্ঞতা হয়েছে তার ওপর ভিত্তি করে তিনি এটিকে অনেক অনেক বড় করে সবাইকে দেখিয়ে দিতে চান তার সামর্থ্য কতোখানি! তিনি নিজে অনেক কষ্ট করেছেন, কিন্তু নিজের সন্তানদের জন্য এক সমৃদ্ধ ভবিষ্যত গড়ে দিয়ে যেতে চান। সময় স্বামীর দিকে তাকিয়ে মৃদু কটাক্ষ করে বললেন, ‘আমার স্বামী কাজকে এখন ভয় পান, কিন্তু আমি কোনো ভয় পাই না। এখন দশটি গরু দোয়াই, দরকার হলে আরো এক শটা গরুর দুধ দোয়াবো। আমি এই গাভীর খামারের শেষ দেখে ছাড়ব ইনসাল্লাহ।

 

দেশের ভবিষ্যত বিনির্মাণে উন্নয়নের চাকাকে যারা সামনে ঠেলে নিয়ে চলেছেন তাদেরই একজন দৃঢ় সাবলীল সালমা খাতুনের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে যখন পথে নামলাম তখন চারদিক অন্ধকার নেমে এসেছিল, কিন্তু আমাদের সামনে ধ্রুবতারার মতো ¦লজ¦ করে ¦লছিল সালমার দু চোখে ফুটে ওঠা আশার আলো।

Ñ মনজুর শামস

 

----------------------------------------------------------------------------------



করোনাকালের সফল উদ্যোক্তা বকুল আক্তার

পটভূমি : জন্মের পরই প্রবল প্রতিকূল পরিস্থিতির মুখে পড়তে হয়েছে তাকে। শারীরিক প্রতিবন্ধকতার জন্য নাজেহাল হতে হয়েছে মানসিকভাবে। কিন্তু একটুও দমে যাননি তিনি। অবিরাম লড়ে গেছেন নিজেকে যোগ্য প্রমাণের জন্য। অবশেষে তিনি তা পেরেছেন। এমনকি করোনা মহামারির চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে নিজেকে একজন লাভবান উদ্যোক্তা প্রমাণে সক্ষম হয়েছেন তিনি। নাম তার বকুল আক্তার। তার লড়াইস্পৃহাও ঘ্রাণ ছড়ায় বকুলের।

ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নবীনগর উপজেলার রতনপুর ইউনিয়নের বাজেবিশাড়া গ্রামের বকুল আক্তার জন্মেছেন বিকলাঙ্গ হয়ে। তার দুটি হাতই স্বাভাবিকের চেয়ে বেশ ছোট। তিনি তার পিতা মরহুম আবুল কাশেম ও মা সখিনা বেগমের পাঁচ সন্তানের ভেতর পঞ্চম। সন্তান জন্ম নিলে বাবা-মায়ের সুখের সীমা থাকে না, কিন্ত বকুলের জন্ম সুখের চেয়ে দুঃশ্চিন্তাই বেশি বয়ে নিয়ে এলো পরিবারে; কারণ ছোট ছোট দুটি হাত নিয়ে শারীরিক প্রতিবন্ধী হয়ে জন্ম নিয়েছিলেন তিনি। বেড়ে উঠতে উঠতে লাঞ্ছনা আর গঞ্জনা সয়ে যেতে হয় তাকে। এমনিতেই আমাদের সমাজে কন্যাসন্তান জন্ম নিলে মা-বাবার দুশ্চিন্তার অন্ত থাকে না, সেখানে মেয়ে যদি হয় শারীরিক প্রতিবন্ধী তা হলে তো কথাই নেই! জ্ঞান হওয়ার পর থেকেই বকুলকে খেলার সাথিদের তিরস্কার সহ্য করতে হয়েছে, বাঁকাচোখে তাকিয়েছে আশপাশের মানুষ। হাত দুটি অস্বাভাবিক বলে তাকে লেখা শিখতে হয়েছে অনেক কষ্ট করে। অনেকে তো ভাবতেই পারেনি তিনি লেখাপড়া শিখতে পারবেন! তিনি তার মেজো বোনের সহযোগিতায় বাসায় স্বরবর্ণ, ব্যঞ্জনবর্ণ লিখতে শিখেছেন। অবশ্য অন্যদের তুলনায় অনেক পরে তার স্কুলজীবন শুরু হয়েছিল। শিক্ষকদের আন্তরিকতার এবং কয়েকজন সহপাঠীর সহযোগিতায় তিনি ২০১১ সালে  এসএসসি এবং ২০১৪ সালে  এইচএসসি  পরীক্ষায় পাস করেন। স্নাতক দ্বিতীয় বর্ষে পড়ার সময় বাবা মারা গেলে সংসারে ঘোর অন্ধকার নেমে আসে।

দক্ষতা/ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড : টিউশনি করে জমানো কিছু টাকা এবং কিছু টাকা ধার করে তিনি বিকাশের এজেন্সি নিয়ে লেনদেন শুরু করেন। এভাবে অনেক সংগ্রামের পর ২০১৮ সালে স্নাতক পাস করেন এবং সিদীপ  সমৃদ্ধি কর্মসূচির শিক্ষিকা হিসেবে কাজ শুরু করেন। পরের বছর বিয়ে করেন, কিন্তু শ^শুর-শাশুড়ি তাকে এখনও মেনে নেননি। তার এই দুঃসময়ে পাশে দাঁড়ায় সিদীপ। এবার তিনি চাকরি ও জমানো টাকায় ব্যবসা শুরু করেন।

অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে ব্যবহৃত পুঁজি এবং পুঁজির উৎস : ২০১৯ সালের ৯ অক্টোবর তাকে রতনপুর শাখা থেকে ৩০ হাজার টাকা আয় বর্ধনমূলক ঋণ (আইজিএ) দেয়া হলে তিনি কাপড়ের ব্যবসা শুরু করেন।

অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে কোভিড-১৯-এর বিরূপ প্রভাব : বকুলের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে বিরূপ প্রভাব পড়েছিল কোভিড-১৯-এর কারণে। তার স্বামীর কাঁচামালের ব্যবসা এবং তার কাপড়ের ব্যবসা থমকে যায় করোনার কারণে। 

বিরূপ প্রভাব মোকাবেলার ক্ষেত্রে এল আর এল কার্যক্রমের ভূমিকা : করোনাজনিত কারণে কাপড়ের ব্যবসায় ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় সিদীপ, রতনপুর শাখা থেকে এল আর এল কার্যক্রমের আওতায় তাকে বিকাশ ব্যবসা প্রকল্পের ওপর ৫০ হাজার টাকা  ঋণ দেয়া হয়। এ ঋণ পেয়ে তিনি বাড়িতে বসেই বিকাশ-এর মাধ্যমে টাকা লেনদেনের মাধ্যমে পুনরায় অর্থনৈতিক কর্মকা- শুরু করতে সক্ষম ।

অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের বর্তমান অবস্থা : বর্তমানে তিনি বিকাশ ব্যবসা ছাড়াও গরু পুষছেন এবং  তার স্বামী আবার কাচঁমালের ব্যবসা শুরু করেছেন। সব মিলে এখন তার অর্থনৈতিক কর্মকা- বেশ ভালোই চলছে।

উদ্যোক্তার ভবিষ্যত পরিকল্পনা : বকুল আক্তার ভবিষ্যতে কাপড় ও বিকাশের ব্যবসার পাশাপাশি দক্ষ গরুর খামারি হয়ে লাভবান হতে চান। বিকলাঙ্গ শরীরের কারণে তাকে যে গঞ্জনা সইতে হয়েছে, একজন বড় উদ্যোক্তা হয়ে বকুল তার মোক্ষম জবাব দিতে চান। একই সঙ্গে  তিনি দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতেও অবদান রাখতে চান।

 

 

 

 

 

 

 

চৌকস চাষি দম্পতি আমেনা-মুনসুর নতুন স্বপ্ন সূর্যমুখীতে

 

নিজেদের ভাগ্য তারা নিজেরাই গড়ছেন। দারিদ্র্যকে রূপ দিয়েছেন ঐশ^র্যময় সৃষ্টিশীলতায়। অভাবে অভাবে মুখ থুবড়ে পড়তে থাকা সংসারকে সৃষ্টিশীল মেধা আর লড়াকু কর্মস্পৃহায় সুখ ও স্বাচ্ছন্দ্যের পথে নিয়ে এসেছেন। এখন সূর্যমুখী ফুলের চাষে নিজেদের ভবিষ্যত নিয়ে নতুন স্বপ্ন দেখছেন  চৌকস চাষি দম্পতি আমেনা বেগম ও মুনসুর আলী। এভাবেই তারা তাদের এগিয়ে চলায় যোগ করে চলেছেন উদ্ভাবনের বৈচিত্র্যময় মাত্রা। আর তাদের উন্নয়নযাত্রায় ঋণ সহায়তার ডালি হাতে সব সময়েই পাশে থাকছে সিদীপ। 
কৃষিতে এই সাফল্য-কাহিনি গাজীপুর জেলার শ্রীপুর উপজেলার মাওনা ইউনিয়নের সিংগারদিঘী গ্রামের মোছাম্মৎ আমেনা বেগমের। জীবনসঙ্গী স্বামী মোঃ মুনসুর আলী তার এই কৃষি উদ্যোগেও সার্বক্ষণিক বিশ^স্ত সাথি। এক সময়ে তাদের সংসারে অভাব-অনটন লেগেই থাকত। নিজেদের ২ বিঘা জমি যদিও ছিল, কিন্তু টাকার অভাবে সেই জমিতে ফসল ফলানো সম্বব হতো না। সংসার চালানোর জন্য আমেনার স্বামী মুনসুর প্রায় সারা বছরই অন্যের জমিতে শ্রম বিক্রি করত। খুবই অল্প কয়েকটা দিন নিজেদের জমিতে কাজ করার সুযোগ পেতো। এভাবেই জোড়াতালি দিয়ে কোনো রকমে চলছিল তাদের সংসার।

                                               
আমেনা বেগমের পরিবারের সদস্য চারজন। স্বামী-স্ত্রী এবং দুই সন্তানÑ এক ছেলে ও এক মেয়ে । অভাবের কারণে সন্তানদের পড়ানোর কথা ভাবতেও পারতেন না। স্বামী-স্ত্রী দুজনে দিনরাত হাড়ভাঙা পরিশ্রম করার পরও  তাদের সংসারের অভাব কখনো দূর হতো না। সেই দুর্দিনে আমেনা বেগম প্রতিবেশীদের কাছ থেকে জানতে পারেন, সিদীপ নামে একটি সংস্থা দরিদ্র পরিবারের লোকদের বিভিন্ন ধরনের ঋণ সহায়তা দিয়ে থাকে, যার কিস্তি প্রতিমাসে বা সপ্তাহে পরিশোধ করতে হয়। এছাড়া সংস্থাটি আরো এক ধরনের ঋণ দেয়, যার কিস্তি ছয় মাস বা এক বছরের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে পরিশোধ করতে হয়। এককালীন পরিশোধের এ বিষয়টি তার খুব ভাল লেগে যায় এবং তার মধ্যে এ ঋণ নেয়ার আগ্রহ জাগে। বিষয়টি নিয়ে আমেনা বেগম তার স্বামীর সাথে আলোচনা করেন এবং ঋণের টাকা দিয়ে তাদের জমিতে এবং আরো জমি লিজ রিয়ে তাতে বিভিন্ন সবজি চাষ করে লাভের টাকা দিয়ে ঋণ পরিশোধ করা সম্ভব এবং লাভবান হওয়া সম্বব বলে তার স্বামীকে জানান। স্ত্রীর ভাবনা বাস্তবসম্মত মনে করে স্বামী মুনসুর আলী স্ত্রীর কথায় সম্মত হন এবং সিদীপ থেকে ঋণ নেয়ার সিদ্ধান্ত নেন। এরপর আমেনা  বেগম ২০১৪ সালের ০৭ জুলাই মাওনা  ব্রাঞ্চে সিদীপের সদস্য হয়ে সাধারণ ঋণ গ্রহণ করেন এবং ২০১৮ সালে সিদীপ থেকে কৃষি ঋণ বা এসএমএপি ঋণ নেয়া শুরু করেন। তিনি প্রথম ধাপে ২০১৪ সালের ০১ সেপ্টেম্বর ৬০,০০০ টাকা সাধারণ ঋণ গ্রহণ করেন এবং এ টাকা দিয়ে তিনি তার দুই বিঘা জমির সাথে আরো এক বিঘা জমি লিজ নেন এবং সেখানে লাল শাক, পালং শাক, মরিচ, ফুলকপি, বাঁধাকপি, গাজর, মুলা ইত্যাদি সবজি চাষ করেন। তার সবজির ফলন খুব ভালো হয় এবং ভালো দামে সেগুলো বিক্রি করেন। এরপর ২০১৫ সালের ০৮ আগস্ট ৮০ হাজার টাকা সাধারণ ঋণ নেন এবং তার আগের তিন বিঘা জমির সাথে আরো দুই বিঘা জমি লিজ নেন এবং একইভাবে বিভিন্ন সবজি চাষ করতে থাকেন। তৃতীয় ধাপে ২০১৬ সালের ১৬ জুলাই ১ লাখ টাকা সাধারণ ঋণ নেন এবং এ টাকা দিয়ে পাঁচ বিঘা জমিতে একইভাবে বিভিন্ন সবজি চাষ করেন এবং  একটি ষাঁড় গরু কেনেন এবং সেটিকে মোটাতাজা করে বিক্রি করেন। ২০১৭ সালের ১০ আগস্ট চতুর্থ ধাপে ১ লাখ টাকা সাধারণ ঋণ নেন। এবার তিনি তার সবজি খেত হতে লাভের টাকা এবং ষাঁড় বিক্রির লাভের টাকা দিয়ে একইভাবে বিভিন্ন সবজি চাষ করেন এবং তিনটি এঁড়ে বাছুর কিনে মোটাতাজা করে বিক্রি করেন। পঞ্চম ধাপে ২০১৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি ৬০,০০০ টাকা সাধারণ ঋণ নেন এবং এ টাকা দিয়ে তিনি তার আগের পাঁচ বিঘা জমির সাথে আরো তিন বিঘা জমি লিজ নিয়ে সবজি চাষ করেন। ২০২০ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি ৮০ হাজার টাকা সাধারণ ঋণ গ্রহণ করেন এবং সে টাকা দিয়ে তার সবজি খেতে সেচ দেয়ার জন্য একটি সেচ পাম্প স্থাপন করেন।
বর্তমানে আমেনা বেগম আট বিঘা জমিতে সবজি চাষ করছেন এবং তার সাতটি বড় গরু এবং দুইটি বাছুর রয়েছে। এর মধ্যে দুটি  গাভী রয়েছে, যা থেকে দিনে ১২ থেকে ১৫ লিটার দুধ পাচ্ছেন। পরবর্তীতে সিদীপ কর্মকর্তারা তাকে শ্রীপুর উপজেলা কৃষি কমকর্তা এবং  মাওনা ইউনিয়ন পরিষদের উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তার  সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দেন এবং বর্তমানে তিনি কৃষি অফিস থেকে বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা পেয়ে থাকেন। ধীরে ধীরে তার শ্রীপুর উপজেলা প্রাণী সম্পদ কর্মকর্তার সাথেও যোগাযোগ হয় এবং এসব যোগাযোগের ভিত্তিতে তিনি বিভিন্ন  প্রশিক্ষণ কর্মসূচিতে অংশ নিয়ে কৃষি ও প্রাণিসম্পদ সম্পর্কে বেশ ভালো জ্ঞান অর্জন করেছেন। পাশাপাশি সিদীপ থেকে আয়োজিত বিভিন্ন কৃষি প্রশিক্ষণ কর্মসূচিতেও তিনি নিয়মিত অংশ নিয়ে থাকেন।
আমেনা বেগম প্রথম ৩০,০০০ টাকা এসএমএপি  ঋণ নেন ২০১৯ সালের ১০ ডিসেম্বর। এ ঋণের টাকা দিয়ে তিনি তার জমিতে শিম,লাউ, ফুলকপি,বাঁধাকপি, টমেটো এবং ধান চাষ করেন। ছয় মাসে আমেনা বেগম তার সবজি খেত থেকে প্রায় ৯০,০০০ টাকার সবজি বিক্রি করেন এবং সব খরচ বাদ দিয়ে তার লাভ হয় ৪০,০০০ টাকা। দ্বিতীয় দফায় ২০২০ সালের ৯ জুলাই ৪০ হাজার টাকা এসএমএপি ঋণ নেন। এ ঋণের টাকা আগের লাভের টাকার সাথে মিলিয়ে ৬০ হাজার টাকা দিয়ে সবজি চাষ করেন ও গরুর বিভিন্ন খাদ্য কেনেন। 
আমেনা বেগম এসএমএপি ঋণ নেয়ার আগে টেকনিক্যাল ওরিয়েন্টেশনের সময় মাওনা ইউনিয়নের উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তার সঙ্গে পরিচিত হন এবং তিনি তাকে দুই বিঘা জমিতে সূর্যমুখী ফুল চাষের জন্য বীজ ও ফুল চাষে সার্বিক সহযোগিতা করার আশ্বাস দেন। তিনি তার ছয় বিঘা জমিতে চক্রাকার পদ্ধতিতে সবজি চাষ শুরু করেন, যাতে সব সময় তার সবজি খেত থেকে  সবজি বিক্রি করতে পারেন এবং বাকি দুই বিঘা জমিতে সূর্যমুখী ফুল চাষ করেন। 
বর্তমানে আমেনা বেগম তার সবজি খেত থেকে প্রতি সপ্তাহে প্রায় ৩০ হাজার টাকার সবজি বিক্রি করেন।  তার খরচ হয়েছিল প্রায় ১৮ হাজার টাকা। এছাড়া তার সূর্যমুখী ফসলের অবস্থাও ভাল এবং সব সময় এই ফসলের কোনো সমস্যা বা রোগবালাই হচ্ছে কিনা তা সিদীপের কৃষি কর্মকর্তা এবং মাওনা ইউনিয়ন পরিষদের উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা নিয়মিত যোগাযোগ রাখছেন। আমেনা বেগম বলেন এই ফসল উৎপাদন করতে তার জমি, সার , জমি চাষ, সেচ, নিড়ানি ও কর্তন বাবদ প্রায় ১৫ থেকে ১৮ হাজার টাকা খরচ হবে। বর্তমানে ফসল যে অবস্থায় আছে তাতে এ ফসল বিক্রি করে প্রায় ৬০ থেকে-৭০ হাজার টাকা পাওয়া যাবে। আমেনা বেগম ও তার স্বামী মুনসুর আলী জানান সূর্যমুখী ফুল চাষ করে এক মৌসুমে ৪৫ থেকে ৫২ হাজার টাকা লাভ করা সম্ভব। তারা ঠিক করেছেন আরো বেশি জমিতে সূর্যমুখী ফুল চাষ করবেন, যাতে তাদের জীবনেও সূর্যের হাসি ফোটে। 
ভীষণ অভাবে নাকা-ি চুবানি খেতে থাকা সেই আমেনা বেগম এখন তার আগের টিনের বেড়ার ঘর ভেঙে ইটের ঘর নির্মাণের জন্য ইট কিনেছেন এবং স্বামী-সন্তান নিয়ে সুখে সংসার করছেন। ছেলে-মেয়ে পড়াশোনা করছে। নিজেদের সাফল্যে গর্বিত আমেনা জানান, পরিশ্রম করলে সাফল্য আসবেই। তবে তার জন্য সঠিক পরিকল্পনা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ দরকার।

 

শুঁটকি ব্যবসায় দারিদ্র্য ঘুচিয়ে মিরা রানী এখন সফল উদ্যোক্তা

 

ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার আশুগঞ্জ উপজেলার লালপুর এলাকাটি নদী,খাল, বিলবেষ্টিত। এখানকার মানুষের আয়ের প্রধান উৎস মাছ চাষ, ছোট খাটো ব্যবসা ও কৃষি অন্যতম। লালপুরের কান্দাপাড়া বসবাস করে শতাধিক জেলে পরিবার। মাছ ধরে বিক্রি করেই চলে এসব পরিবার। তবে বর্তমানে এসব পরিবারের অনেকেই পুঁটি মাছের সিদল/ চেপা শুঁটকি তৈরি ও বিক্রি করে নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তন করেছেন। হ্যাঁ তাদেরই একজন মিরা রানী।
মিরা রানীর যখন বিয়ে হয় তখন তার স্বামী নদীতে মাছ ধরে বিক্রি করে খুব কষ্টে সংসার চালাতেন। অভাব-অনটনের সংসার ছিল। স্বামী বিকাশ দাসের পক্ষে কিছুতেই পরিবারের অভাব অনটন থেকে বের হওয়া সম্ভব হচ্ছিল না। দিন দিন পরিবারের সদস্য সংখ্যা বাড়তে থাকে। বর্তমানে ৫ মেয়েসহ তার পরিবারের সদস্য ৭ জন। আয়ের একটি বাড়তি পথ খুঁজতে খুঁজতে এক সময় মিরা রানীর স্বামী মাছ ধরে বিক্রির পাশাপাশী মাছ শুকিয়ে শুঁটকি তৈরি করে স্থানীয় বিভিন্ন সাপ্তাহিক হাটে বিক্রি করতে থাকেন। দিনদিন এতে ভালো লাভ হতে থাকে । তখন মিরা রানীর স্বামী বিকাশ দাস ভাবতে থাকেন শুঁটকির ব্যবসাটাকে কীভাবে আরও বড় করা যায়! বিষয়টি নিয়ে মিরা রানীর সাথে আলাপ করেন। আলোচনা করে দুজনেই ঠিক করেন শুঁটকি ব্যবসাটা আরো বড় করবেন। কিন্তু  অর্থের অভাবে তা সম্ভব হচ্ছিল না। অগত্যা মিরা রানী তার কিছু সোনার অলঙ্কার বিক্রি করে ১ লাখ টাকা দিয়ে পুঁটি মাছ কিনে শুকিয়ে শুঁটকি তৈরি করে বাজারের পাশাপাশি বিভিন্ন আড়তে বিক্রি করতে থাকেন। এভাবে চলতে থাকে মিরা রানী ও বিকাশ দাসের সংসার। 

শুঁটকি থেকে আয় বাড়তে থাকায় তাদের এ ব্যবসা আরো বড় করে তোলার ইচ্ছেটাও বাড়তে থাকে। তারা স্বপ্ন দেখেন ব্যবসাটাকে আরও বড় করার এবং পাশাপাশি একটি আড়ত খুলবেন। এমন অবস্থায় ২০১৭ সালে তাদের আলাপ হয় সিদীপ-এর একজন কর্মীর সাথে। বিকাশ দাস তার স¦প্নের কথা কর্মীকে জানালে সেই কর্মী তাকে জানিয়েছিলেন, সিদীপ তাকে এ ব্যাপারে আর্থিক সহায়তা দিতে পারে। তার পরামর্শক্রমে মিরা রানী সিদীপের সেখানকার একটি মহিলা সমিতিতে যোগ দেন এবং ঋণের আবেদন করেন। যাচাই শেষে তার ঋণ প্রস্তাব অনুমোদন করে ২০১৭ সালের ৬ জুন তাকে ৪৮,০০০ টাকা ঋণ দেয়া হয়। এই টাকা দিয়ে পুঁটি মাছ কিনে সেগুলো কুটিয়ে মাচা/ডাংগির মধ্যে শুকিয়ে মাটির মটকিতে ভরে গুদামজাত করেন। এভাবে তাদের ব্যবসার পরিধি বাড়তে থাকে এবং এই দম্পতি নিজেদের পরিবারের পাশাপাশি তাদের আড়তে কর্মরত ৮-১০ জন কর্মচারীর পরিবারের দায়িত্ব নেয়। এভাবে এক বছর কাটার পর ২০১৮ সালে মিরা রানী সিদীপ থেকে আরো ১,৫০,০০০ টাকা ঋণ নিয়ে তা ব্যবসায় বিনিয়োগ করেন। ধীরে ধীরে তাদের ব্যবসার পরিধি এবং লোকবল বাড়তে থাকে। এরপর মিরা রানী ২টি শুঁটকির আড়তের মালিক হন এবং ২০ জন কর্মচারী নিয়োগ করেন।  
এভাবে ধীরে ধীরে মিরা রানী ও বিকাস দাসের শুঁটকির ব্যবসা বাড়ছে। তাদের শুঁটকির চাহিদা দিন দিন বাড়তে থাকায় তারা   উৎপাদন আরো বাড়ানোর চিন্তাভাবনা করেন। কিন্তু তাদের কাছে যে পরিমাণ অর্থ ছিল তাতে উৎপাদন সেভাবে বাড়ানো সম্ভব হচ্ছিল না। অগত্যা তারা আবারো সিদীপের সঙ্গে যোগাযোগ করেন এবং সিদীপ বরাবরের মতো তাদের পাশে দাঁড়ায় এবং তাদের ৩,০০,০০ টাকা ঋণ সহায়তা প্রদান করে। এই টাকা দিয়ে তারা পুঁটি মাছের পাশাপাশি লইট্যা, পোয়া, বাইন ইত্যাদি মাছ কিনে শুকিয়ে শুঁটকি তৈরি করে এলাকার চাহিদা মিটিয়ে দেশের বিভিন্ন জেলায় বাজারজাত করতে থাকেন এবং তাদের আয় বেশ বাড়তে থাকে। বর্তমানে তাদের ব্যবসায় ৫০ লাখ টাকার পুঁজি রয়েছে। এখন প্রতি মাসে তাদের মাসিক আয় গড়ে ২ লাখ টাকা। শুঁটকি ব্যবসায় দারিদ্য ঘুচিয়ে এভাবেই এখন একজন সফল উদ্যোক্তা।

 

সাফল্যের সিঁড়ি বেয়ে যেভাবে এগিয়ে যাচ্ছেন নাসিমা

নেহাত পেটের দায়ে কাজ করে যান তারা। ভোরের আলো ফোটার আগেই লেগে যান জমিতে ফসল ফলাতে, জলাশয়ে মাছচাষে, গরু-ছাগল-হাঁস-মুরগি পুষতে, নকশিকাঁথার শৈল্পিক কারুকাজে, নরম মাটি ছেনে ছেনে ইমারত আর নানা নির্মণযজ্ঞের ইট গড়তে এবং এই ধরনের আরো অনেক ঘাম ঝরানো কাজে। কারো কোনো অনুকম্পার ধার না ধেরে জীবন বাঁচানোর অহর্নিশ প্রয়াসে তারা নিজেদের রুটি-রুজির সংস্থান করে নেন। নিজস্ব মেধা, শ্রম আর উদ্ভাবনী প্রতিভায় ভর করে এদের অনেকেই হয়ে ওঠেন স্বাবলম্বী। কারো কারো উদ্যোগ এনে দেয় সচ্ছলতা। হয়ে ওঠেন এলাকার সফলতা-প্রত্যাশীদের জন্য অনুকরণীয় উদাহরণ। এদেরই একজন হচ্ছেন মুন্সিগঞ্জ সদর উপজেলার শোল্লাপাড়া গ্রামের নাছিমা বেগম। তারা শুধু নিজের সংসারের সাবলীল সচ্ছলতাই আনেন না, দেশের অর্থনীতির চাকাকেও করে তোলেন আরো বেগবান। মূলত এই নাসিমাদের হাত ধরেই উন্নতির সোপান বেয়ে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ।


এই তো, মাত্র কয়েক বছর আগের কথা। ভীষণ কষ্টে চলছিল নাছিমার সংসার। তার স্বামী মো. মহিউদ্দিন সামান্য একটু জমিতে চাষাবাদ করে কোনো রকমে সংসার চালাতেন। নাছিমা গেরস্তালির কাজ করতেন। দুই মেয়েকে বহু কষ্টে বিয়ে দেয়ার পরও সংসারের টানাটানি কমছিল না। দুই ছেলের কারোই লেখাপড়া চালিয়ে যেতে পারেননি। এক সময় মহিউদ্দিন একটু বড় পরিসরে ভালোমতো চাষাবাদ করবেন বলে চড়া সুদে গ্রামের এক মহাজনের কাছ থেকে ঋণ নিয়েছিলেন। পরিশ্রমের মাত্রাও বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু এতো করেও হালে পানি পাননি তিনি। যা আশা করেছিলেন, ফসল ফলেছিল তার চেয়ে অনেক অনেক কম। একেবারে কোমর ভেঙে পড়েছিল তার। স্বামীর দিকে তাকাতে পারতেন না নাছিমা। খুব কষ্ট হতো। নিজে কিছু করে সংসারের আয় বাড়ানোর জন্য উপায় খুঁজছিলেন। এক সময় নাছিমা তার এক প্রতিবেশীর কাছ থেকে জানতে পারেন সিদীপ নামের এক এনজিও সবজি চাষের জন্য এসএমএপি ঋণ দেয়। জাপান সরকারের উন্নয়ন সংস্থা জাইকা এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক সহায়তায় তারা এই প্রকল্প পরিচালনা করে থাকে। নাছিমা তখন সিদীপের শোল্লাপাড়া মহিলা সমিতিতে যোগ দেন এবং সবজি চাষের জন্য ঋণের আবেদন করেন। সম্ভাব্যতা যাচাই করে তাকে সিদীপ থেকে ৫০ হাজার টাকা এসএমএপি ঋণ দেয়া হয়। এই ঋণ নিয়ে নাসিমা ও তার স্বামী আলু, টমেটো, বেগুন ইত্যাদি চাষ করতে থাকেন এবং সংসারের অভাব কিছুটা ঘোচাতে সক্ষম হন। এ সময় তার বড় ছেলে গাভী পুষে কিছুটা সহায়তা করতে চাইলে নাছিমা এবং তার স্বামী ধার-দেনা করে স্থানীয় হাট থেকে দুটি গাভী কিনে আনেন। এই দুই গাভীর দুধ বিক্রি করে সংসারের আয় একটু একটু বাড়তে থাকে। নাছিমা ও মহিউদ্দিন এতে গাভী পালনে আরো আগ্রহী হয়ে ওঠেন। এভাবে যতোই দিন যেতে থাকে তাদের উৎসাহ ততোই বাড়তে থাকে। অন্য কয়েক জায়গা থেকেও ঋণ নেন নাসিমা। স্বামী আর দুই ছেলেসহ ফজরের ওয়াক্ত থেকে রাত পর্যন্ত ভীষণ পরিশ্রম করতে থাকেন সবজি চাষে আর গরু পালনে। এর ফলও পান। নাছিমার এখন ৩০টি গরু, যার ১৫টিই গাভী। এখন তিনি রোজ ৫০ থেকে ৬০ লিটার দুধ বিক্রি করতে পারেন। কখনো দাম কমে ৫০ টাকায় বিক্রি হয় প্রতি লিটার দুধ, আবার কখনো ৬০ টাকা এমনকি ৮০ টাকা লিটার দরেও দুধ বিক্রি করতে পারেন। গরুর গোবর থেকে সার তৈরি করেও আয় করছেন। এই গরুর খামারের জন্য তিনি এক একর জমিতে নেপিয়ার জাতের ঘাস চাষ করছেন। পাশাপাশি আলু, টমেটো, বেগুন ইত্যাদি সবজিও চাষ করছেন, যা থেকে মাসে অন্তত ১০ হাজার টাকা লাভ করছেন। সিদীপের উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা তার সবজি চাষ ও গরু পালনে নানা পরামর্শ দিয়ে সহায়তা করেন। প্রাণিসম্পদ উন্নয়নের ওপর এসএমএপি’র আওতায় সিদীপ এক প্রশিক্ষণ আয়োজন করলে নাছিমাকেও প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। এ ছাড়া তার সবজি চাষ এবং গরু পালনে কোনো সমস্যা দেখা দিলে সিদীপের কৃষি কর্মকর্তা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তার সঙ্গে পরামর্শ করে তা সমাধানের চেষ্টা করে থাকেন। এভাবেই দিনদিন নিজের আর্থিক ভিত আরো মজবুত করে চলেছেন নাছিমা বেগম।  
নাছিমা এখন গোটা এলাকার মানুষের কাছে এক প্রেরণার নাম। নিজের ও দেশের আর্থিক উন্নয়নের অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত। নিজের সাফল্য নিয়ে কিছু বলার অনুরোধ করলে এই প্রতিবেদকের কাছে তিনি জাইকা ও বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে বলেন, ‘সিদীপের মাধ্যমে আমি শুধু জাইকা ও বাংলাদেশ ব্যাংকের ঋণ সহায়তাই পাইনি, আমি যাতে সফল হতে পারি সেজন্য তারা আমার প্রশিক্ষণেরও ব্যবস্থা করেছে। 

 

 

শিসক শিক্ষিকা শাহীনুরের সফল উদ্যোগ

 

স্বামী মারা যাওয়ার পর দুই সন্তানকে নিয়ে দু চোখে অন্ধকার দেখছিলেন শাহীনুর বেগম। এক পুত্র এবং এক কন্যাসন্তান নিয়ে গলগ্রহ হয়ে পড়েছিলেন শ^শুরবাড়িতে। ছেলে-মেয়ের ভবিষ্যৎ-চিন্তায় চোখে সর্ষেফুল দেখছিলেন। তার ওপর উঠতে-বসতে কথার খোঁচা তাকে আরো বিভ্রান্ত করে দিচ্ছিল। এতো দুর্বিপাক, এতো অপমান, এতো অনিশ্চয়তার মধ্যেও নিজের সন্তানদের লেখাপড়া চালিয়ে যাবেন বলে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন। বিয়ের আগেই এসএসসি পাশ করেছিলেন, তাই নিজেই পড়াতেন ছেলে-মেয়েকে। পাশাপাশি প্রতিবেশীদের শিশুদেরও পড়াতেন অর্থের বিনিময়ে। তার পড়ানোর কৌশলে মুগ্ধ হয়ে গ্রামের অভিভাবকেরা তাদের শিশু-সন্তানদের পড়াশোনার ভার তার কাঁধে তুলে দিয়ে নিজেরা এ ব্যাপারে নির্ভার থাকতেন। তার এই গুণপনার কথা ছড়িয়ে পড়লে সিদীপের চন্দ্রগঞ্জ শাখার শিক্ষা সুপারভাইজার আকলিমা আক্তার মুক্তা এক সময় তা জেনে যান এবং তিনি শাহীনুরকে সিদীপের শিক্ষা সহায়তা কর্মসূচিতে (শিসক) একজন শিক্ষিকা হিসেবে যোগ দেয়ার প্রস্তাব দেন। শাহীনুর এ প্রস্তাব লুফে নেন। নিজের উঠোনে শিশুদের একটি শিক্ষাকেন্দ্র খুলে সিদীপের একজন শিসক শিক্ষিকা হিসেবে কাজ শুরু করেন। এতে সংসারের অভাব কিছুটা ঘুচলেও শ^শুরবাড়ির নিন্দার জাল কেটে আলাদা সংসার করার অবস্থায় যেতে পারেননি। তিনি বেশ বুঝতে পারছিলেন সন্তানদের ভবিষ্যৎ জীবন সুগম করতে হলে তাকে আয়ের একটি স্থায়ী পথ খুঁজে বের করতে হবে। এরই মধ্যে চন্দ্রগঞ্জ শাখায় সিদীপের শিক্ষিকা সমিতি গঠিত হলে তিনি এক ঝলক আশার ইঙ্গিত দেখতে পেলেন।

তিনি তার শাখার শিক্ষিকা সমিতিতে যোগ দিলেন এবং মাসে মাসে সঞ্চয় শুরু করলেন। এরপর সিদীপ শিক্ষিকা সমিতি থেকে ২০ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে ঘরে বসে পোশাক বিক্রির ব্যবসা শুরু করেন। তিনি স্থানীয় পাইকারি বাজার থেকে শিশু ও নারীদের বিভিন্ন পোশাক এবং থান কাপড় কিনে এনে গ্রামবাসীদের কাছে বিক্রি করতে থাকেন। তিনি একজন শিসক শিক্ষিকা বলে গ্রামের নারী ক্রেতাদের কাছে বাজারের দোকানদারদের চেয়ে বেশি বিশ^স্ত ছিলেন, আর সেজন্যই দ্রæত তিনি তার ব্যবসায় উন্নতি করতে সক্ষম হন। এর ফলে এক সময় তিনি তার ছেলে-মেয়েকে নিয়ে শ^শুরবাড়ি থেকে বেরিয়ে এসে নিজের মতো করে সংসার চালাতে থাকেন। 
এখন তার একমাত্র উদ্দেশ্য ব্যবসাটাকে আরো বড় করে তুলবেন, যাতে ছেলে-মেয়েকে সুশিক্ষিত করে নিজের পায়ে দাঁড় করিয়ে দিতে পারেন। একই সঙ্গে গ্রামের শিশুদের দেশের সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে শিসকের শিক্ষিকা হিসেবেও কাজ করে যেতে চান শাহীনুর। 

 

 

 

 হাসি ফুটেছে গুরুদাসপুরের বড়ই চাষিদের মুখে

 

বড়ই কুল চাষের জন্য নাটোরের গুরুদাসপুর আগে থেকেই বিখ্যাত। এ বছর এখানকার বড়ই চাষিরা সম্ভাবনার আরো কয়েক ধাপ উপরে উঠে গেছেন, আর এর পেছনে অনুঘটক হিসেবে কাজ করেছে জাইকা ও বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক সহায়তায় পরিচালিত সিদীপের এসএমএপি কার্যক্রম। সিদীপের গুরুদাসপুর শাখার কর্ম-এলাকায় মামুদপুর, বের গংগারামপুর, নাজিরপুরসহ বিভিন্ন গ্রামে সিদীপের অনেক সদস্য শস্য ও শাক-সবজির পাশাপাশি বিভিন্ন উন্নত জাতের বড়ই বা কুল চাষ করে থাকেন, যা তাদের আর্থিকভাবে বেশ লাভবান করে থাকে। তারা যেসব উন্নত জাতের বড়ই চাষ করে থাকেন তার ভেতরে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে বলসুন্দরী, কাশ্মিরি, নারকেলি কুল, বাউকুল ও আপেলকুল। এই বড়ই বা কুল চাষের ওপর তারা অনেকটাই নির্ভরশীল। এই উন্নত জাতের কুল চাষের জন্য সিদীপ গুরুদাসপুর শাখা হতে সাধারণ ঋণের পাশাপাশি  এসএমএপি ঋণ গ্রহণ করে থাকেন। এ বছর কুল চাষ করে সিদীপের গুরুদাসপুর শাখার বেশ কয়েকজন সদস্য ব্যাপক সফলতার সম্ভানার দারপ্রান্তে পৌঁছেছেন। সিদীপের এই এসএমএপি ঋণী সদস্যগণ এ বছর একেকজন সদস্য ৩-৪ বিঘা জমিতে উন্নত জাতের  কুল চাষ করেছেন এবং এই মধ্যে তা বাজারজাত শুরু হয়েছে। সাধারণত তাদের এক বিঘা জমিতে ১২০/১৫০ মণ পর্যন্ত কুল উৎপন্ন হয়ে থাকে। প্রতিমণ কুল জাত ভেদে তারা বিভিন্ন দরে বাজারজাত করে থাকেন, যেমনÑ  যেমন বর্তমানে প্রতিমণ বলসুন্দরী ৪,০০০ টাকায়, কাশ্মিরি ৩,০০০ টাকায়, নারকেলি কুল ২,৫০০ টাকায় এবং বাউ কুল ও আপেল কুল প্রতিমণ ১,৫০০ টাকায় বাজারজাত করছেন। ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, সিলেট, ফেনীসহ দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে আরতদার ও বেপারিরা তাদের জমি থেকে নগদ টাকায় বড়ই কিনে নিয়ে যায় । প্রতিবিঘা জমির বড়ই তারা গড়ে ১,২০,০০০ টাকা থেকে ১,৫০,০০০/টাকায় বিক্রি করতে পারেন।